মা: ভালোবাসার চিরন্তন ছায়া

"মা"—মাত্র একটি শব্দ, অথচ এই শব্দের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার সবচেয়ে বিশুদ্ধ, সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে অনন্ত রূপ। মা মানেই আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নীরব উপস্থিতিতে আগলে রাখা নির্ভরতার ছায়া। এই পৃথিবীতে অনেক সম্পর্ক থাকে, কিন্তু মা-সন্তানের সম্পর্ক এমন এক বন্ধন, যা জন্মের আগেই গড়ে ওঠে এবং মৃত্যুর পরেও হৃদয়ে বেঁচে থাকে।
প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় মা দিবস। যদিও এই একটি দিনে মাকে বিশেষভাবে সম্মান ও ভালোবাসা জানানো হয়, প্রকৃত অর্থে মা দিবস প্রতিটি সন্তানের জীবনে প্রতিটি দিনের সঙ্গী হওয়া উচিত। একজন মা সন্তানের জীবনে যেমন নিঃস্বার্থ সেবায় নিয়োজিত থাকেন, ঠিক তেমনই সমাজ ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ গঠনে তাঁর রয়েছে অনন্য ভূমিকা।
একজন মা সন্তানকে শুধু জন্ম দেন না, গড়ে তোলেন। তাঁর হাত ধরেই আমরা হাঁটতে শিখি, কথা বলতে শিখি, ভালোবাসতে শিখি। শিশু যখন কথা বলতে জানে না, তখনও মায়ের ভাষা সে বোঝে। তার কান্না, হাসি, ইশারাতেই মা বুঝে যায় সন্তানের প্রয়োজন।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর প্রতিটি প্রধান ধর্মেই মায়ের মর্যাদা অসাধারণ। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত বলে ঘোষিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, “আল্লাহর সন্তুষ্টি মায়ের সন্তুষ্টিতে, আর আল্লাহর অসন্তোষ মায়ের অসন্তোষে।” হিন্দু ধর্মে মা কেবল একজন নারীর পরিচয় নয়, বরং দেবীত্বের প্রতীক। দেবী দুর্গা শক্তির, লক্ষ্মী সমৃদ্ধির, সরস্বতী বিদ্যার রূপ। খ্রিষ্ট ধর্মে মাদার মেরীকে স্বর্গীয় মর্যাদায় স্থাপন করা হয়েছে, যিনি পবিত্রতা, ত্যাগ ও ভালোবাসার প্রতীক। বৌদ্ধ ধর্মেও মাতৃত্বকে করুণার উৎস হিসেবে দেখানো হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণগুলো একত্র করে যদি বলা যায়—"মা" শব্দটি নিজেই এক আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিচ্ছবি।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, একজন মা-ই একটি জাতির চরিত্র গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। পরিবার গঠন, নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অপরিসীম। একটি শিশু প্রথম শিক্ষা লাভ করে মায়ের কোলে। মায়ের মুখে উচ্চারিত আদর্শই পরবর্তীতে সেই সন্তানের জীবনের নীতিমালা হয়ে ওঠে।
সাহিত্যেও মাকে নিয়ে অসংখ্য লেখা রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে মাকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “আমার মা মরিয়াছেন, জানেনা সে দাস”, কাজী নজরুল ইসলামের "মা" কবিতা কিংবা জীবনানন্দ দাশের গদ্যে-মা বারবার ফিরে এসেছে অভয়ার প্রতীক হয়ে।
আমার নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর অবিরাম স্নেহ, নিঃশর্ত সমর্থন আর কঠোর পরিশ্রম আমাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। জীবনের নানা চ্যালেঞ্জে যখন দিশেহারা হয়েছি, তখন তাঁর একটি কথাই ভেতরে শক্তি জুগিয়েছে—“তুই পারবি।” একজন মা শুধু সন্তানকে আদর করেন না, তাঁকে সাহসও দেন, দৃঢ়তা শেখান।
আমার জীবনের লক্ষ্য শুধু নিজের জন্য নয়, মায়ের জন্যও। আমি চাই এমন এক অবস্থানে পৌঁছাতে, যেখানে মা কোনোদিন আর চিন্তা না করেন।
আজকের এই মা দিবসে আমরা যারা সৌভাগ্যবান, যাদের মা এখনো পাশে আছেন—তারা যেন মা-কে সময় দিই, ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। আর যারা তাঁদের হারিয়েছেন, তাঁরাও মায়ের শিক্ষা, ভালোবাসা ও স্মৃতিকে জীবনের আলো করে রাখেন। ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা প্রকাশ করা হয়। তাই শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিটি আচরণে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমরা যেন মাকে সম্মান জানাই।
মা শুধু জন্মদাত্রী নন, তিনি ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তিনি এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যিনি নিজের স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়ে সন্তানের স্বপ্নকে রঙিন করেন। মা মানে আত্মত্যাগ, মা মানে সাহস, মা মানে ভালোবাসা। তাঁর ছায়ার নিচে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই এক জীবনের সমান আশীর্বাদ।
মাইনুল ইসলাম অমি
২য় বর্ষ
লোকপ্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: