জননিরাপত্তা ও শ্রমবাজার উভয়ই চরম ঝুঁকিতে; প্রমাণ সাপেক্ষে ফাঁস হলো ক্ষমতার দাপটে সরকারি কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দেওয়ার অডিও

বিএমইটি পরিচালক ও এজেন্সির মালিক তিতাসের 'কোটি টাকার সিন্ডিকেট': বহির্গমন ছাড়পত্রে ঘুষ

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর বহির্গমন শাখা এখন কেবল শ্রমিক হয়রানির কেন্দ্র নয়, এটি পরিণত হয়েছে একটি ভয়ংকর কোটি টাকার সিন্ডিকেটের দুর্নীতির আখড়ায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সিন্ডিকেটের এক প্রান্তে রয়েছেন বিএমইটি’র পরিচালক (বহির্গমন) মোঃ তাজিম-উর-রহমান (উপ সচিব), অন্য প্রান্তে রয়েছেন প্রভাবশালী রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স টি এম ওভারসিজ (আর এল-০৪৯৮)-এর স্বত্বাধিকারী এ.এইচ.এম মঈন উদ্দিন, যিনি 'তিতাস' নামে পরিচিত।

অনুসন্ধানে কেবল শ্রম অভিবাসন সংক্রান্ত দুর্নীতির চিত্রই উঠে আসেনি, পাওয়া গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে থাকা এই মঈনুদ্দিন তিতাস মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) নিয়ম ভঙ্গ করে ২৫ টন অতি স্পর্শকাতর রাসায়নিক (এসিটোন) অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এসিটোন হলো ককটেল বোমা এবং কোকেন-হেরোইনের মতো মাদক তৈরির অন্যতম কাঁচামাল।

এই সিন্ডিকেটের অবৈধ কর্মকাণ্ডে একদিকে বিদেশে গমনেচ্ছু শত শত শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে মাদক ও জঙ্গি তৎপরতার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের জননিরাপত্তা গুরুতর হুমকির মুখে।

বহির্গমন ছাড়পত্রে ‘ঘুষ ছাড়া গতি নেই’: সাপ্তাহিক লেনদেন কোটি টাকা

সূত্রের তথ্যানুসারে, বিএমইটি’র পরিচালক মোঃ তাজিম-উর-রহমান কার্যত এজেন্সির মালিক মঈনুদ্দিন তিতাসের নির্দেশে চলেন। বহির্গমন সংক্রান্ত অবৈধ কাজ দ্রুত পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়।

কম্বোডিয়া সিন্ডিকেট: সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বড় শিকার কম্বোডিয়াগামী কর্মীরা। মঈনুদ্দিন তিতাসের ইন্ধনে পরিচালক তাজিম-উর-রহমান কম্বোডিয়াগামী কর্মীদের বৈধ সত্যায়নকৃত ভিসার সকল বহির্গমন ছাড়পত্রের ফাইল সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আটকে দেন।

কর্মীদের অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ সূত্রমতে, আটকে থাকা প্রতিটি ফাইল ছাড় করার জন্য পরিচালক ৫,০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা করে ঘুষ দাবি করছেন। এই টাকা পরিশোধ না করলে ছাড়পত্র মিলছে না। যার ফলে শত শত কর্মীর বিদেশ যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, এই দুর্নীতি শুধু কম্বোডিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ দ্রুত ছাড়পত্র ইস্যু করার জন্য বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে নিয়মিতভাবে অবৈধ অর্থ আদায় করা হচ্ছে। ঘুষ দিতে অস্বীকৃত হলে এজেন্সিগুলোর ফাইল আটকে দেওয়া হয়, যার ফলে শ্রম অভিবাসন খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।

রাসায়নিক চোরাচালান ও ক্ষমতার দাপট: তিতাসের ভয়ংকর প্রোফাইল

মঈন উদ্দীন তিতাস, যিনি টি এম ওভারসিজ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী হিসেবে পরিচিত, তার ক্ষমতার আসল উৎস কেবল বিএমইটি-তে নয়, বরং তার বিরুদ্ধে মাদকের কাঁচামাল চোরাচালানের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

২৫ টন এসিটোন পাচার: অনুসন্ধানে জানা যায়, তিতাস ২৫ টন (১৫৪ ড্রাম) এসিটোন আমদানি করেন। এটি মাদক শ্রেণিভুক্ত (প্রি-কারসার কেমিক্যাল)। ডিএনসি’র নিয়ম অনুযায়ী, বন্দর থেকে খালাসের পর এটি অনুমোদিত গুদামে সংরক্ষণ করতে হয় এবং মোড়ক উন্মোচনের আগে ডিএনসি’র অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তিতাস কোনো নিয়ম না মেনে, ডিএনসি'র অনুমোদনের আগেই সম্পূর্ণ রাসায়নিক গোপনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল পরিমাণ এসিটোন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে পড়লে তা দেশে বড় ধরনের জননিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

সরকারি কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি: তিতাসের ক্ষমতা ও প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর, তা উঠে এসেছে একটি অডিও রেকর্ডে। যখন ডিএনসি’র উপ-পরিচালক হামিমুর রশিদ তার এই চোরাকারবার ধরে ফেলেন, তখন মঈন উদ্দীন তিতাস তাকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে হুমকি দেন।

অডিও রেকর্ডে তিতাসকে বলতে শোনা যায়, "আপনাকে আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বদলি করতে পারি। আপনি বহুত বাড়াবাড়ি করছেন।" তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি আইন মানবেন না এবং অনুমোদন নেবেন না। ডিএনসি কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে তার দম্ভোক্তি ছিল, "আমাকে আইন দেখায়েন না। আমি অনুমোদন নেব না। দেখি আপনি কি করেন।"

তিনি উপ-পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে 'নন-ক্যাডার' আখ্যা দিয়ে তাকে প্রশ্ন করার এখতিয়ার নেই বলেও দাবি করেন।

ক্ষমতার উৎস: প্রশাসন ক্যাডারের স্ত্রীর প্রভাব

অনুসন্ধানে জানা যায়, মঈনুদ্দিন তিতাস তার ক্ষমতা প্রদর্শনের পেছনে তার স্ত্রীর পদবিকে ব্যবহার করছেন। তার স্ত্রী প্রশাসন ক্যাডারের ১৮ ব্যাচের একজন যুগ্ম সচিব। অভিযোগ রয়েছে, স্ত্রীর উচ্চ পদবি এবং ক্ষমতার দাপট দেখিয়েই তিতাস বেপরোয়া আচরণ করছেন এবং ডিএনসি সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রভাব খাটাচ্ছেন।

এছাড়া, ডিএনসি’র চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের দুজন অতিরিক্ত পরিচালকের (মজিবুর রহমান পাটোয়ারী এবং একেএম শওকত ইসলাম) সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি অনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি

বিএমইটি’র একজন শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি এবং একই সিন্ডিকেটের হোতার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক চোরাচালানের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠায় পুরো শ্রম অভিবাসন এবং জননিরাপত্তা খাতেই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনা কেবল সাধারণ প্রশাসনিক দুর্নীতি নয়, এটি একটি সংগঠিত অপরাধ। দ্রুত এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জরুরি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, "যে ব্যক্তি শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে খেলছে এবং একইসঙ্গে দেশের জননিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে বিস্ফোরক রাসায়নিক পাচার করছে, তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কেবল বিএমইটি পরিচালক নয়, তিতাসের ক্ষমতার মূল উৎস এবং তার স্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টিও তদন্তের আওতায় আনা উচিত। অন্যথায়, দেশের ভাবমূর্তি এবং শ্রমবাজার উভয়ই স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"

এ বিষয়ে পরিচালক (বহির্গমন) মোঃ তাজিম-উর-রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মঈন উদ্দীন তিতাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দ্রুত এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দেশের শ্রম অভিবাসন খাতে নৈরাজ্য আরও চরম আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top