সাইবার অপরাধ : নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ ও আইন
 ড. বি এম মইনুল হোসেন |  প্রকাশিত:  ৩ অক্টোবর ২০২১ ১৮:২৩
 ড. বি এম মইনুল হোসেন |  প্রকাশিত:  ৩ অক্টোবর ২০২১ ১৮:২৩
 
                                ডিজিটালাইজেশনের এই বৈশ্বিক আলোড়নের যুগে কম পরিবর্তন হয়নি আমাদের এই বাংলাদেশেও। সরকারি সেবা থেকে শুরু করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ই-কমার্স থেকে শুরু করে এফ-কমার্স, কোথায় লাগেনি পরিবর্তনের হাওয়া! আমাদের স্থবিরতার ধুলাবালি, ডিজিটাল হাওয়া কতটুকু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, তবে ধীরে ধীরে যে আমরা ডিজিটাল সেবার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত।
যেকোনো পরিবর্তনই সম্ভাবনার সুবাতাস সমাজে, রাষ্ট্রে প্রবেশ করে; তবে সাথে করে নিয়ে আসে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দিকও; সেটি অবশ্য টের পাওয়া যায় সময় গড়ানোর সাথে সাথে। ডিজিটাল মাধ্যম আমাদের সমাজে জায়গা করার কিছুদিনের মধ্যেই পাল্লা দিয়ে চলে এসেছে ডিজিটাল অপরাধ বা ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ। প্রয়োজন হয়ে পড়ল নিয়মনীতি, আইনকানুনের; প্রয়োজন হয়ে পড়ল সুরক্ষার, ডিজিটাল আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
এই পরিস্থিতি যে একেবারেই অপ্রত্যাশিত তা কিন্তু নয়। শুধু সাধু মানুষেরা ডিজিটাল হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই, কখনো ছিলও না। বরং সশরীরে না হয়ে, কম্পিউটারের আড়ালে থেকেও যেহেতু ডিজিটাল দুনিয়ার অনেক বড় বড় অপরাধ করে ফেলা যায়, সেটি এক শ্রেণির অপরাধীর কাছে ধরা দিয়েছে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায় বিভিন্ন সংস্থা, রাষ্ট্র, সরকার।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়ে আসতে হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার। মূলত, অপরাধের মাধ্যম ও ধরন বহু যুগ ধরে চলে আসা অপরাধের চেয়ে ভিন্নতর হওয়ায়, ব্যাপক পরিমাণে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের দরকার পড়ে বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়ম-নীতির।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই অপরাধগুলো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সংঘটিত হয়ে থাকলেও বেশিরভাগ অপরাধের মূল কারণ কিন্তু কারিগরি অর্থাৎ প্রযুক্তিগত নয়, বরং মানুষের জীবনাচরণ, সহজাত প্রবৃত্তি কিংবা মানবিক দোষ-ত্রুটিই অনেক ক্ষেত্রে প্রধান কারণ।
কম্পিউটারের আড়ালে থেকেও যেহেতু ডিজিটাল দুনিয়ার অনেক বড় বড় অপরাধ করে ফেলা যায়, সেটি এক শ্রেণির অপরাধীর কাছে ধরা দিয়েছে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে।
বাংলাদেশ সাইবার থ্রেট ল্যান্ডস্কেপ রিপোর্ট ২০২০ অনু্যায়ী, গত বছরের তুলনায় যে ধরনের সাইবার অপরাধগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তথ্য পাচার (ইনফরমেশন লিকেইজ এবং ইনসাইডার ট্রেডিং)। যেটি আসলে স্বল্পতম কারিগরি জ্ঞান এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো ধরনের কারিগরি জ্ঞান না থাকলেও করা সম্ভব।
সমস্যা হলো, ডিজিটাল পরিমণ্ডলের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করা হলেও, সে সমস্ত আইনের ভিন্নতর ব্যাখ্যার সুযোগ নিয়ে, অনেক সময় ঘটে যায় আরেক ধরনের অপরাধ। হেনস্থা হয় মানুষ, সম্মুখীন হয় আর্থিক, সামাজিক, মানসিক ক্ষতির। ন্যায়বিচারের পরিবর্তে কপালে জুটে হয়রানি আর অসহায়ত্ব।
আমাদের দেশে ডিজিটাল মাধ্যম বা সে সংশ্লিষ্ট যে আইনসমূহ রয়েছে, সেসব আইনে করা মামলাগুলোর ডেটা বিশ্লেষণ করলেই প্রকৃত অবস্থা বেরিয়ে আসবে। কতগুলো মামলায় সাজা হয়েছে? কতগুলো মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা গেছে? কতগুলো মামলা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে? এসব চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে তুলে ধরা এখন জরুরি।
সারা বিশ্বে ডিজিটাল মাধ্যমের নিয়মকানুন, রীতিনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ, ডিজিটাল প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি প্রযুক্তি। সেই ধারাবাহিকতায়, আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট আইনেরও সমস্যাজনক জায়গাগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলোর জন্য যুগোপযোগী সমাধান বা পরিবর্তন নিয়ে আসা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
একজন নির্দোষ লোককে যদি ডিজিটাল আইনে করা মামলায় জামিন দেওয়া না হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, তার অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি, তাহলে এমনটি প্রতীয়মান হতে পারে যে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বা ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য প্রণীত আইন ব্যবহার করে মানুষকে আসলে ভোগান্তিই দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সাইবার থ্রেট ল্যান্ডস্কেপ রিপোর্ট ২০২০ অনু্যায়ী, গত বছরের তুলনায় যে ধরনের সাইবার অপরাধগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তথ্য পাচার। যেটি আসলে স্বল্পতম কারিগরি জ্ঞান এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো ধরনের কারিগরি জ্ঞান না থাকলেও করা সম্ভব। 
ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলার ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকলে, সেটি অনভিপ্রেত। জামিন অযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে অপরাধগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করা, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা মামলার ক্ষেত্রে বাদীর জন্য নিরুৎসাহমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার যৌক্তিকতা আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এই সমস্ত মামলার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থার কারিগরি দক্ষতা। ভুক্তভোগী যখন আইনের আশ্রয় নেন, তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ প্রমাণের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার করা ফরেনসিক রিপোর্ট বা তদন্তের উপর নির্ভর করতে হয়। এই সংস্থাগুলোর যে লোকবল আছে, তাদের দক্ষতার উপর নির্ভর করবে ডিজিটাল মাধ্যমে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেটি প্রমাণিত হবে নাকি হবে না।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থাগুলোতে যারা কাজ করেন, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আবার, সাইবার সিকিউরিটি বা ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে যারা কাজ করনে, তাদের যদি কিছুদিন পর একেবারেই ভিন্ন একটি জায়গায়, ভিন্ন কাজের জন্য বদলি করা হয়, সেক্ষেত্রেও তাদের অনেক দিনের অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে না।
অন্যদিকে, দেশে বা দেশের বাইরে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি, এমনকি উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রিধারী দক্ষ ব্যক্তিদেরকে স্থায়ীভাবে, প্রয়োজনে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। খণ্ডকালীন চাকরি বা অস্থায়ী পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে স্থায়ী সমাধান পাওয়া কঠিন হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় শক্তিশালী গবেষণা দল থাকে, যারা বিভিন্ন ধরনের বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে কার্যকর উপায়ে তদন্ত করার, প্রমাণ সংগ্রহ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সময়ের সাথে আমাদের এতদিনের পরিচিত জগতটা ডিজিটাল হয়ে গেছে বা হতে শুরু করেছে। সাথে সাথে অনেক বড় বড় অপরাধও ডিজিটাল মাধ্যমে চলে এসেছে। এই ডিজিটাল পরিমণ্ডলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বর্তমান সময়ের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। সময়োপযোগী নীতিমালা, কার্যকর আইন, দক্ষ লোকবল, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। আমরা যদি এখনই এই বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগী না হই, আমাদের সামনের সময়টুকু কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকবে।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
bmmainul@du.ac.bd

-2021-08-29-21-21-25.gif)
 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: