টাকার খনি অবৈধ সংযোগ!

টাকার খনি অবৈধ সংযোগ!

গত বৃহস্পতিবার রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঝিলপারের বস্তির নিজ বাসায় ফিরছিলেন মিজানুর রহমান (৩০)। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), মেয়ে লিমা (৭) এবং সাত মাসের শিশুপুত্র হোসাইন। রিকশা না পাওয়ায় বৃষ্টিতে জমে থাকা হাঁটু পানিতে হেঁটে হেঁটেই ফিরছিলেন তারা। মিরপুরে কমার্স কলেজ সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছলে হঠাৎ বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে যান স্ত্রী মুক্তা বেগম। এ সময় সাত মাসের শিশু সন্তানকে ছুড়ে ফেলায় সে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। স্ত্রীকে ধরতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হন স্বামী মিজানুর রহমান। এরপর বিদ্যুতায়িত হন মেয়ে লিমা। তাদের বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হন অনিক নামের স্থানীয় আরও এক যুবক। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে উদ্ধার করতে করতে সবাই চলে যান না ফেরার দেশে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু ঝিলপারের বস্তিতেই এক হাজারের মতো পরিবার থাকে। যেখানকার অধিকাংশ সংযোগই অবৈধ। চারটি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। গত শনিবারও সরেজমিনে গিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তারের মাধ্যমে বস্তিতে দেয়া সংযোগের অভিনব পদ্ধতি চোখে পড়ে। জানতে চাইলে ঝিলপার বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, এই বস্তিতে প্রায় এক হাজার পরিবার থাকে। এখানকার অধিকাংশ লাইনই অবৈধ। মেইন লাইন থেকে হুকের মাধ্যমে সংযোগ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন জড়িত। তারাই সংযোগ দিয়ে যান টাকার বিনিময়ে।


এ ছাড়া যখন বড় স্যাররা অভিযান চালাতে আসে তখন আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়। ফলে অভিযানের আগেই হুগ খুলে ফেলা হয়। পরে তারা যখন আবার চলে যায় তখন আবার লাইন দেয়া হয়। আর বাসিন্দা বলেন, খুঁটি থেকে লাইন নিয়ে মাটির নিচ দিয়ে বস্তিতে নেয়া হয়। এরপর সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে দেয়া হয়। ফলে বিষয়টা চোখে পড়ে না। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব বস্তি ঘিরে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। সংযোগের বিনিময়ে এসব সিন্ডিকেটের লোকজন টাকা তুলে নিলেও তা পায় না সরকার। পরে এসব অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে কিছু যায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে। বাকিটা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।

এ ছাড়াও সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বস্তি, ফুটপাতে ভাসমান দোকানের লাইট এমনকি অটোরিকশা চার্জিং স্টেশনের অধিকাংশ সংযোগই অবৈধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অবৈধ সংযোগের ফলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিতরণি সংস্থার কতিপয় অসাধু লোক লাভবান হলেও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি। আবার চোরাই বিদ্যুৎ সিস্টেম লস হিসেবে দেখানোর অভিযোগও পুরোনো। তাই এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে প্রথমে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় গঠিত হয় ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই অথরিটি (ডেসা)। পরে অনিয়মের মুখে পড়ে বিলুপ্ত হয় ডেসা। নতুন করে গঠিত হয় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। বিদ্যুতের গ্রাহকদের অভিযোগ, দুটি বিতরণ কোম্পানি থেকে তারা আশানুরূপ সেবা পাচ্ছেন না। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নতুন সংযোগ পেতে অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হচ্ছে।

এ অবস্থায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের তরফে বিভিন্ন সময় সিস্টেম লস কম করে দেখানো হলেও তা আসলে কমে না, উল্টো সিস্টেম লসের নামে গোঁজামিল দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, এ খাতে সিস্টেম লসের কারণে অপচয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ খাতে সামগ্রিকভাবে বছরে গড় সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি কমে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চালন লাইনে ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে এটি বেড়েছে।

সরেজমিনে রাজধানী ঢাকার অলিগলি ও মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে অটোরিকশা ও ইজিবাইক। মূলত প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব অটোরিকশা ও ইজিবাইকের পারমিশন দেয়া হলেও এখন এ সুযোগ নিচ্ছে সবাই। পায়ে চালিত রিকশা থেকে এসব রিকশা চালানো সহজ। রাজধানীর মূল সড়কে এসব অটোরিকশা চলার অনুমতি না থাকলেও কখনও কখনও মূল সড়কেও দেখা যায়। রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইকচালক সংগ্রাম পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখের মতো। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা, বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। এসব অটোরিকশার ব্যাটারি বিদ্যুতের চার্জে চলে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জে দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। যার অধিকাংশই মূল লাইন থেকে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে। ফলে এর অর্থ সরকার পাচ্ছে না। বিশ্লেষকদের মতে, একটি রিকশা প্রতিদিন চার্জ বাবদ খরচ করছে পাঁচ ইউনিট বিদ্যুৎ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। রাজধানীতে আছে প্রায় ১২ লাখ। প্রতিটি রিকশায় বৈধভাবে চার্জ দেয়ার জন্য মাসে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। এসব রিকশা অলিগলিতে চলে। তবে মূল সড়কে উঠলেই ডাম্পিং করা হয়। তাছাড়া ডিএমপি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অবৈধ গ্যারেজ বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

শনিবার রাত সাড়ে ১১টা। সরেজমিনে রাজধানী রায়ের বাজারের চান মিয়া খাঁন সড়কে গিয়ে এসব অটোরিকশার চার্জিংয়ের একাধিক গ্যারেজ চোখে পড়ে। এসব গ্যারেজে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ গ্যারেজেই চোরাই পদ্ধতিতে চার্জ দেয়া হচ্ছে। তবে গ্যারেজেই বৈদ্যুতিক মিটার রয়েছে। তবে এসব মিটারের ‘OUT’ পয়েন্ট থেকে তার খুলে ‘IN’ পয়েন্টে লাগানো। ফলে মেইন লাইন থেকে বিদ্যুৎ মিটারে না গিয়ে সরাসরি অটোরিকশা চার্জ হচ্ছে। আর মিটারে না যাওয়ায় এসব বিদ্যুৎ খরচের কোনো হিসেব উঠছে না মিটারে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর এসব অটোরিকশা ও ইজিবাইক চার্জিং স্টেশনের প্রায় ৯০ শতাংশই চার্জ করা হয় অবৈধ পদ্ধতিতে। ঢাকার দুই সিটির বিভিন্ন এলাকাতে চলছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা।

এ ছাড়াও বিদ্যুৎ চুরির আর একটি খাত হলো রাজধানীর ফুটপাতের দোকান। তথ্য বলছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে ফুটপাত। এসব ফুটপাতের সাড়ে ৩ লাখ দোকানে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ অবৈধ বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে। বাতিপ্রতি গড়ে ৩০ টাকা হিসেবে উত্তোলন করা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন উত্তোলন করা হয় অন্তত দেড় কোটি টাকা। আর প্রতিমাসে উত্তোলন করা হয় প্রায় ৪৫ কোটি টাক। আর বছর শেষে অঙ্ক দাঁড়ায় ৫৪০ কোটিতে। তবে এসব লাইটের অধিকাংশই অবৈধ সংযোগ হওয়ায় এসব টাকা পাচ্ছে না সরকার। এসব টাকার ভাগ যায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির অসাধু কর্মচারীদের পকেটেই। তবে ফুটপাতের দোকানে বিদ্যুৎ খরচের বেশির ভাগ হিসাব নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিপিডিসির দৈনিক প্রায় ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুরি হয়। ডিপিডিসির সিস্টেম লস ৭ শতাংশ আর ডেসকোর ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিদ্যুতে ১ শতাংশ সিস্টেম লস হলে ক্ষতি হয় ৭০০ কোটি টাকা। আর এ সিস্টেম লসের হার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য বিবেচনার চেয়ে বেশি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী বলেন, অটোরিকশার চার্জিং স্টেশনগুলোতে আমরা নিয়মিত নজরদারি করছি। এ ছাড়াও তাদের বিলের প্রতিও নজর রাখা হচ্ছে। কোথাও অসংগতি দেখলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফুটপাতের লাইটের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়েও আমাদের নজরদারি চলছে। মিরপুরের দিকে কিছু ফুটপাতে এমন লাইন আছে। তবে অধিকাংশই বিভিন্ন দোকান থেকে নেয়া সংযোগ বলে দাবি করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অভিযানে গেলে তারা অবৈধ সংযোগ সরিয়ে ফেলে। আবার চলে আসলে দেয়। পুরো জায়গাটা সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখাও কষ্টকর।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top