173

04/16/2024 বিধি ভেঙে দুই জায়গার বেতন ভাতা নিচ্ছেন অধ্যক্ষ রফিকুল

বিধি ভেঙে দুই জায়গার বেতন ভাতা নিচ্ছেন অধ্যক্ষ রফিকুল

ইমন রহমান

৩০ নভেম্বর ২০২১ ২২:০৩

 লঙ্ঘন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং কলেজ উভয় জায়গা থেকে আর্থিক সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। তিনি ২০১২ সালের ৯ জুলাই থেকে কখনো প্রেষণে আবার কখনো লিয়েনে (পদাধিকারে ছুটি) লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। আর এই দীর্ঘ সময় ধরে তিনি মাউশি এবং লালমাটিয়া মহিলা কলেজ দুই জায়গা থেকেই বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিধি ভেঙে আর্থিক সুবিধা নেওয়া ছাড়াও অধ্যক্ষ ড. মো. রফিকুল ইসলাম প্রতি বছর নিজের আয়করের ১১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কলেজের তহবিল থেকে নেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের, স্ত্রী ও মেয়ের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অঢেল সম্পদ অর্জন এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরকারিকরণের প্রক্রিয়াধীন লালমাটিয়া মহিলা কলেজে নিবন্ধনহীন ৫৫ জন শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত রবিবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা। দুদকে জমা দেওয়া পাঁচ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের সঙ্গে প্রমাণস্বরূপ ৯৪ পাতার নথিপত্র সংযুক্ত করেছেন তিনি।

জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর মাউশি থেকে উপসচিব শ্রীকান্ত কুমার চন্দ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ড. মো. রফিকুল ইসলামকে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে প্রেষণে বদলি/পদায়ন করা হয়। সেখানে নিজ বেতনক্রম অনুযায়ী বেতন ভাতা গ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠান বিনা ভাড়ায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে কোনো বাড়ি ভাড়া ভাতা পাবেন না এমন বেশ কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয়। তবে চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মাউশি থেকে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলামের বেতন নেওয়ার সেলারি স্টেটমেন্ট (বেতন বিবরণী) হাতে এসেছে। এছাড়া লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকেও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে বেতন-ভাতা নেওয়ার পর মাউশি থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা নিতে পারেন না অধ্যক্ষ রফিকুল, এটি বিধিবহির্ভূত।

দুই জায়গা থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চাকরি আইন সংক্রান্ত বইয়ের লেখক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া  বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে বা লিয়েনে এভাবে যেতে পারে না। আর গেলে সরকারি বেতন-ভাতা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেউ নিলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হওয়ার কথা।’

দুদকে করা অভিযোগে শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বলেছেন, ড. মো. রফিকুল ইসলাম ২০১২ সালের ১২ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রেষণে, ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ এর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত লিয়েনে এবং একই বছরের ২১ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রেষণে নিজ সার্ভিসের বাইরে রয়েছেন। অথচ ৫ বছরের বেশি সময় নিজ সার্ভিসের বাইরে থাকার বিধান নেই (বিএসআর পার্ট-১-এর বিধি ৩৪ এবং লিয়েন বিধিমালা ২০২১-এর ১১ (ক) অনুযায়ী)। অধ্যক্ষ (প্রেষণে-নিজ বেতন ও বেতনক্রমে) লালমাটিয়া মহিলা কলেজের পদে পদায়ন আদেশের ১ নম্বর শর্তানুযায়ী নিজ বেতন ও বেতনক্রম অনুযায়ী নিযুক্ত হয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ অফিসের আইবাসপ্লাসপ্লাস থেকে মাসিক ৭৬,৬৮৪ টাকা বেতন নিয়েছেন। এর মধ্যে ১,০০০ টাকা নেন মোবাইল ভাতা ও ২,৪৮৪ টাকা নেন আবাসিক টেলিফোন ভাতা হিসাবে। অথচ প্রেষণে থাকা কোনো কর্মকর্তার সরকারি তহবিল থেকে বেতন, মোবাইল ভাতা ও আবাসিক টেলিফোন ভাতা নেওয়ার বিধান নাই।

ওই অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অধ্যক্ষের বসবাসের জন্য কলেজের নিজস্ব ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে। তাই পদায়ন আদেশের ৩ নম্বর শর্তানুযায়ী তিনি কোনো বাড়ি ভাড়া ভাতা পাবেন না। কলেজ থেকে বেতন গ্রহণের আদেশ থাকলেও তিনি মন্ত্রণালয়ের আইবাসপ্লাসপ্লাস থেকে মাসিক বেতন গ্রহণ করার পরও কলেজ থেকে মাসিক ১,৫০,০০০ টাকা ভাতা ও বেতন বাবদ ২,৫০,০০০ টাকা গ্রহণ করেছেন। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে ২০২১-২২ করবর্ষে কলেজ থেকে বার্ষিক বেতন বাবদ ৪২,০৯,৭৬৯ টাকা নিয়েছেন। এছাড়া ব্যক্তিগত আয়কর পরিশোধ করতে কলেজ ফান্ড থেকে নিয়েছেন ৮,৮৬,২৮১ টাকা। চলতি বছরের ৩০ জুন তিনটি আলাদা বিলের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার বণ্টন বাবদ নিয়েছেন ৯,১৮,০৯৫.৭৮ টাকা। বহিঃপরীক্ষার বণ্টন খাত থেকে ৩০টি পরীক্ষা বাবদ নিয়েছেন ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ করবর্ষে সর্বমোট গ্রহণ করেছেন ৬৯,১৪,১৪৫ টাকা। সরকারি আদেশ ও বিধিবিধান অমান্য করে দুই দপ্তর থেকে বেতন ও ভাতা এবং ব্যক্তিগত আয়করের অর্থ গ্রহণ পরিষ্কার দুর্নীতি।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লিয়েনে নিয়োগ নিয়ে মাসিক বেতন ২,৫০,০০০ টাকাসহ বার্ষিক বেতন ও ভাতা ৫২,৩৫,৮৬৮ টাকা হারে নিজের আয়কর বাবদ বার্ষিক ১১,৭৪,৪৮০ টাকা নিয়েছেন। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আয়কর বাবদ মোট ৯১,২৯,৩২৫ টাকা, বৈশাখী ভাতা বাবদ ৫০,০০০ টাকা এবং অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার বণ্টন বাবদ শুধুমাত্র ২০২০ সালের ৩০ জুন ৫টি বিলের মাধ্যমে নিয়েছেন ১৭,০৯,০৩৩.৫৫ টাকা। ৪৮টি বহিঃপরীক্ষার বণ্টন বাবদ নিয়েছেন ১৪,৪০,০০০ টাকা। শুধুমাত্র বেতন বাবদ এই কর্মকর্তা ২০২০-২১ আয়কর বর্ষে সর্বমোট ৯২,০২,৩৫১ টাকা তার রিটার্নে আয় দেখিয়েছেন। অর্থাৎ ২০১৬-২০ মাত্র চার বছরে নিয়েছেন ৩,৬৮,০৯,৪০৪ টাকা। এসব অভিযোগের প্রমাণপত্রও যুক্ত করা হয়েছে দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগের সঙ্গে।

ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ নিজ কর্মস্থলের বাইরে রয়েছেন ২০১২ সালের ৯ জুলাই থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে প্রায় ১০ বছর কলেজের বাসায় বসবাস করলেও বাড়ি ভাড়া ও ভাতা গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজের আয়কর ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার বণ্টন বাবদ অর্থ গ্রহণ করেছেন। অথচ অধ্যক্ষ হিসেবে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় ৫,০০০ টাকা ও বহিঃপরীক্ষা বাবদ ১০,০০০ টাকা নেওয়ার বিধান থাকলেও নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। আবার তিনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কলেজ ফান্ড থেকে ৪,১০,০০০ টাকা চিকিৎসা বাবদ আত্মসাৎ করেছেন (কলেজের হিসাব বিভাগের নথিতে প্রমাণ রয়েছে)। তিনি নিজে অস্বাভাবিক বেতন ভাতা গ্রহণ করে কলেজটির তহবিল লুটপাট করলেও কলেজের সব শিক্ষকের বেতনের ইনক্রিমেন্ট ৯ বছর ধরে বন্ধ রেখেছেন। তাদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ২০০৯ সালের বেতন স্কেল অনুয়ায়ী। তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ করতে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফেলতেন। হুমকি দিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষকের কাছ থেকে ইতিমধ্যে মুচলেকা নিয়েছেন।

অঢেল সম্পদের মালিকানার বিষয়ে অভিযোগে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ সরকারি চাকরিজীবী হলেও ঢাকার সাভারের বরদেশী মৌজায় ৭ শতাংশ জমি ৩,৫০,০০০ টাকায় নিজের নামে এবং মেয়ের নামে ৫ শতাংশ জমি ৭,৫৪,০০০ টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন। এছাড়া উদয়াচল বহুমুখী সমবায় সমিতির প্লট ৭,৫০,০০০ টাকা, আকাঙ্খা ডেভেলপার্স লি.-এর ফ্ল্যাট ১,৩৯,৮৬,৬৫৩ টাকা, জাতীয় গৃহায়ন কর্র্তৃপক্ষের ফ্ল্যাট ৩২,৮৪,৬০০ টাকা, সাফা গ্রিন সিটির প্লট ২২,৪৪,০০০ টাকা, জিপিএফ ৬৯,৭০,৯৫৬ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২৩ লাখ টাকা, মেয়ের নামে এফডিআর ৩২ লাখ টাকা, পেনশন সেভিং স্কিমে ১০ লাখ টাকা, স্ত্রীকে প্রদত্ত ধার ৮,৮০,০০০ টাকা ও মৎস্য খামারে বিনিয়োগ ১১ লাখ টাকা। জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন ১৫ লাখ টাকা এবং বসবাসরত বাসার কোটি টাকার আসবাবপত্র ও গোপনে অলঙ্কার তৈরি করেছেন। রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে ২ হাজার বর্গফুটের আড়াই কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনার বিষয়টি গোপন করে জাতীয় গৃহায়ন কর্র্তৃপক্ষের ফ্ল্যাট মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন। এছাড়া নগদ ৮,৯৯,২৫৫ টাকাসহ মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ৩,৯০,০৫,১৯১ টাকা।

অভিযোগে অধ্যক্ষের স্ত্রীর নামে কোটি টাকার ফ্ল্যাট উপহার, নিজের ঘুষ-দুর্নীতির আয় গোপন করতে স্ত্রীর নামে আয়কর রিটার্ন জমা ও মেয়ের নামে ফ্ল্যাট ও প্লটের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। নিয়োগ বন্ধ বা নিয়োগ স্থগিত থাকার পরও অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম ৫৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের ৮০ ভাগের শিক্ষক নিবন্ধনই নেই।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

সম্পাদক:
যোগাযোগ: ৩২/২, প্রিতম জামান টাওয়ার, (১১ তলা), পুরানা পল্টন, ঢাকা - ১০০০
মোবাইল: +৮৮ ০১৭৮৭ ৩১৫ ৯১৬
ইমেইল: infobanglareport@gmail.com