জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প

ঠিক যেন সিনেমার কাহিনী। জিরো থেকে হিরো হওয়ার গল্প। ২০০১ সালে টেকনাফ বন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন নুরুল ইসলাম। এরপর বন্দরে নিজের অবস্থান কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস, দালালির কাজে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তিনি বন্দরে অসাধু একটি দালাল চক্র তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তার সিন্ডিকেটের সদস্যসংখ্যা ১০ থেকে ১৫। সিন্ডিকেটের সহায়তায় নুরুলের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা পাশের দেশ থেকে কাঠ, শুঁটকি মাছ, বরই আচার, মাছ আনার আড়ালে অবৈধ পণ্য নিয়ে আসতেন। এর বাইরে টেকনাফ বন্দর, ট্রাকস্ট্যান্ড, বন্দরে জাহাজের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এভাবে কম্পিউটার অপারেটর থেকে ৪৬০ কোটি টাকার মালিক বনে যান।

নুরুল ইসলাম অত্যন্ত কাজের ব্যক্তি। কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করার সময় বড় বড় ব্যবসায়ী, বন্দরে যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাদের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তিনি তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ আদায় করেন। কীভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া যায়, সেসব কৌশল তিনি ভালোভাবেই রপ্ত করেন। চাকরিরত অবস্থায় নামে-বেনামে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করতেন নুরুল। ওই সময়ই তিনি ভোলা, টেকনাফ, সেন্টমার্টিনে জমি কেনেন। তখন থেকে তিনি জমি কেনাবেচার ব্যবসাও করতেন। মূলত অবৈধ সম্পদকে বৈধ হিসেবে দেখানোর জন্য ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত। গত বছর তিনি নাম লেখান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। সম্প্রতি তিনি র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন। ধরা পড়ার পরই তার কীর্তি-কাহিনীর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন অথচ কেউ কিছু টের পেল না, এটা অবিশ্বাস্য। নুরুল একাই নিশ্চয়ই অনিয়ম বা চোরাকারবারি করেননি। প্রশাসনের কেউ না কেউ তাকে সহযোগিতা করেছেন। প্রশাসনিক সহযোগিতা বা ইচ্ছাকৃত ‘উদাসীনতা’ ছাড়া এমন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে নুরুলকে ব্যবহার করে অনেকে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু তারা আড়ালেই রয়ে গেছেন। হয়তো তাই থাকবেন।

এ রকম নুরুল ইসলামদের খবর কয়েক দিন পরপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো হেরফের হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে এমন বেশ কয়েকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তাদের কেউ ড্রাইভার, কেউ নিম্নমানের করণিক, কেউ রাজনৈতিক দলের অফিস সহকারী। কারও শত শত কোটি, কারও হাজার হাজার কোটি টাকার হদিস মিলছে। কেউ জেলে, কেউ পলাতক, কেউ নিরাপদে বিদেশে চলে গেছে। সামান্য পদ-পদবির লোকজন এত বিপুল পরিমাণ টাকা অবৈধভাবে, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জন করেছে। এতে প্রমাণ হয় এগুলো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আরও বড় দুর্নীতিবাজ, রাঘববোয়াল যাদের বলা হয়, তারা আড়ালেই থেকে গেছেন। থেকে যাচ্ছেন। তাদের কথা অনুমান করা যায় মাত্র।

সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, এই রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সরকার নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা চুনোপুঁটি ধরা পড়ছে এবং খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বরং দেখা যায় প্রকৃত দুর্নীতিবাজরা অবৈধ টাকা ব্যবহার করে গোপনে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আদালত থেকে জামিন পাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও পুলিশি প্রতিবেদনে নির্দোষ হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে। এটা একটা দেশের জন্য অত্যন্ত বিপদের। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। রাঘববোয়ালদের দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে অবধারিতভাবে গোটা বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। তাই দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে।

দেখা যাচ্ছে, ধরা পড়ার পর দুর্নীতিবাজদের সম্পদ ও দুর্নীতির বিস্তারিত খতিয়ান বের হয়। কিন্তু ধরা পড়ার আগে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই মেলে না। আর ধরাই-বা পড়ে কতজন? দু-একজন। না পড়ার সংখ্যাটাই বেশি। নুরুল যে একা নন তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কিন্তু তার সহযোগী, তাকে সহায়তাকারী, তার দুর্নীতি ধরতে না পারা ব্যর্থ কর্মকর্তাদের ধরা হবে কি? তাকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয়-মদদ দিয়েছেন, তাদেরও খুঁজে বের করা দরকার। তাদের জালের মধ্যে না আনতে পারলে নুরুলের স্থানটা দ্রুত পূর্ণ হয়ে যাবে। আবার পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকবে।

অন্যদিকে এদের খুব বেশি দিন আটকে রাখা যায় না, আইনের ফাঁক দিয়ে ঠিক বের হয়ে আসে, তারপর মামলা অনাদিকাল ধরে চলতে থাকে। এ ধরনের অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। এদের মামলা দ্রুত বিচার আইনে শেষ করে, সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। যাতে তাদের এ বার্তাটি দেওয়া হয় যে, একবার ধরা পড়লে শাস্তি তো হবেই, আবার সম্পদও যাবে। তাহলে কিছুটা হলেও অবৈধভাবে টাকা বানানোর প্রচেষ্টা ও ইচ্ছেটা কমে আসবে। টোটকা দিয়ে, ইশারা-ইঙ্গিতে ভয় দেখিয়ে, দু-চারজন নুরুল ইসলামকে ধরে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থামানো যাবে না। এর জন্য সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ‘ঠক বাছতে যদি গ্রাম উজাড়’ হয়, প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। তবু সেই ঝুঁকি নিতে হবে। নেওয়া দরকার।

দুর্নীতি দমন কমিশনে কিছু ‘মেরুদণ্ডওয়ালা’ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল সবার বিরুদ্ধে দলনিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে আইন আরও শক্ত করে এর ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। সরকারের কত কত সংস্থা আছে। পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সবাইকে একযোগে চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ-কমিশনবাজ-ঘুষখোর-অবৈধ উপার্জনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামিয়ে দিতে হবে। তারা যেন আবার ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে না যান, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যারা গত দশকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কর-প্রশাসনকে সক্রিয় করা হোক। দামি বাড়ি-গাড়ির মালিক, বিলাসী জীবনযাপনকারীদের আয়ের উৎস খুঁজে বের করা হোক। গোয়েন্দারা পর্যায়ক্রমে ‘সন্দেহভাজন’ বিত্তবানদের বিত্তের উৎস খুঁজে বের করুক।

আমলা, ছাত্রনেতা, যুবনেতা, মন্ত্রী-এমপি, শিল্পপতি, গণমাধ্যমের মালিক, আর প্রমোদভ্রমণের নামে ঘনঘন বিদেশ সফরকারী, সবার অবৈধ অর্থের খোঁজে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ আয়ের সব টাকা উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে। দেশে সরকারের চেয়ে বড় ‘শক্তি’ আর দ্বিতীয়টি নেই। সরকার যদি সত্যি সত্যি আন্তরিকতা নিয়ে অবৈধ উপার্জনের বিরুদ্ধে মাঠে নামে, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘পাগলাঘণ্টি’ বাজিয়ে দেয়, তাহলে যেকোনো ‘পাগলা কুকুরের’ও ‘লেজ’ সোজা হতে বাধ্য। এর আগে আমরা সেই নমুনা দেখেছি। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা অপরিকল্পিত ঝাঁকুনিতেই কিন্তু ঢাকা শহরের অলিগলিতে টাকার বস্তা, দামি গাড়ি বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল! এখনো সরকার যদি আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে অবৈধ উপার্জনকারীরা আবারও টাকার বস্তা পথে ছুড়ে দেবে। বাড়ি-গাড়ি থুয়ে ভাগবে। দরকার শুধু একটা ‘বিপ্লবী’ সিদ্ধান্ত। এই কাজ করলে দেশের কোটি কোটি মানুষ সরকারের পক্ষে থাকবে। দু-চার লাখ দুর্নীতিবাজ হয়তো বিপক্ষে যাবে, সাবোটাজ করার চেষ্টা করবে, কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষ যদি সরকারের পক্ষে থাকে, তাহলে কি সেই ফাড়া কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব?

আরেকটি কথা। আস্তে আস্তে মানুষের ‘খিদে’টাকেও একটু কমিয়ে আনতে হবে। পোলাও-কোর্মা-বিরানিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ডাল-শাক-ভাত খেতে একটু কষ্ট হবে বৈকি! সেজন্য সুনীতি-সদাচারের দীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শাক-ভাতে’ অভ্যস্ত হওয়ার কথাও বলতে হবে। কৃচ্ছতা শেখাতে হবে। ‘খাই-খাই’ স্বভাবটা বাড়ে প্রশ্রয় পেলে। আর মানুষের পেটের খিদের চেয়ে চোখের খিদে কিন্তু বেশি সর্বনাশা!

লেখক কলামনিস্ট ও লেখক

chiros234@gmail.com




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top