এক চক্রই ৮ বছর ধরে ফাঁস করেছে প্রশ্ন!

এক চক্রই ৮ বছর ধরে ফাঁস করেছে প্রশ্ন!

পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা (ক্যাশ) পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত চক্রটি গত আট বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে। ফাঁস হওয়া ওইসব প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অসংখ্য ব্যক্তি চাকরিও পেয়েছেন। যাদের অনেকে আবার পরে জড়িয়ে পড়েছেন প্রশ্ন ফাঁসের এই চক্রে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনেক কম মেধাবীরা চাকরি পেলেও বঞ্চিত হয়েছেন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা। ফাঁস হওয়া ওই সব প্রশ্নে চাকরি পাওয়াদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি, যাদের মধ্যে ৫ জনই ব্যাংক কর্মকর্তা। এছাড়া আরও ১৫ জনের তথ্য পেয়েছে ডিবি।

ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহাদত হোসেন সুমা  বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে তারা গত ৮ বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছেন। ফাঁস হওয়া এসব প্রশ্নে যারা চাকরি পেয়েছেন তারা কোন কোন ব্যাংকে চাকরি করছেন তা এখনো জানা যায়নি। তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িত ৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া দুই পরীক্ষার্থী সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।’

গ্রেপ্তার মো. মোক্তারুজ্জামান ও শামছুল হক শ্যামল গতকাল শনিবার আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন, চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষার দিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বিভিন্ন বাসায় বসিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হতো। তবে আগের রাতেই তাদের নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হতো। আর চুক্তি অনুযায়ী টাকা নিয়ে নিত পরীক্ষার দুদিন আগেই।

এদিকে প্রশ্ন ফাঁস চক্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই সে অপরাধী না। যে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় রয়েছে। অপরাধী প্রমাণ হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গতকাল  বলেন, ‘একজন কারও নাম বললেই সে অপরাধী প্রমাণ হয় না। তাছাড়া যে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের বিষয়ে পর্যালোচনা, যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় রয়েছে। এরপর চাকরিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গত ৮ বছর ধরে এই চক্র প্রশ্ন ফাঁস করছে ডিবির এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘একটি পরীক্ষায় এমন হয়েছে বলে অন্যান্য পরীক্ষায়ও হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না।’

প্রশ্ন ফাঁস করে অতীতে যারা ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন ডিবির অনুসন্ধানে তাদের নাম এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘চাকরিবিধি ও আচরণবিধি অনুযায়ী যা হয়, সে ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির গ্রেপ্তার হওয়া টেকনিশিয়ান মো. মোক্তারুজ্জামান রয়েল গতকাল তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘দেলোয়ার এবং পারভেজ আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে কাজ করত। দেলোয়ার ও পারভেজ জানায় যে তারা পাঁচটি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদের প্রশ্ন এবং উত্তর ফাঁস করতে পারবে। তাই আমি আমার পরিচিত শ্যামলকে (জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল) পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলি। শ্যামল চারজন পরীক্ষার্থী নিয়ে আমার বাসায় আসে। গত ৬ নভেম্বর সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত উক্ত পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর আমরা পরীক্ষার্থীদের মুখস্থ করাই। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ৬ নভেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল। গত ৪ নভেম্বর শ্যামল আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা আমি আর পারভেজ ২৫ হাজার করে ভাগ করে নিই।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, গ্রেপ্তার শামছুল হক শ্যামল তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘দেলোয়ার, পারভেজ এবং মোক্তার আমার পূর্বপরিচিত। তাদের মাধ্যমে আমি জানতে পারি সম্মিলিত ৫ ব্যাংকের প্রশ্ন তৈরির কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি পেয়েছে। দেলোয়ার, পারভেজ এবং মোক্তার জানায় তারা পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁস করতে পারবে। তারা আমাকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলে। আমি জানে আলম মিলনকে (রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা) পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলি। জানে আলম মিলন পরীক্ষার আগের রাতে চারজন পরীক্ষার্থী নিয়ে আমার কাছে আসেন। তাদের নিয়ে আমি মোক্তারের বাসায় যাই। পরীক্ষার দিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সেখানে দেলোয়ার, পারভেজ এবং মোক্তার পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করায়, যা পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। জানে আলম মিলন আগেই আমাকে এক লাখ টাকা দেয়। গত ৪ নভেম্বর সেখান থেকে আমি মোক্তারকে ৫০ হাজার টাকা দিই।’

গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের ‘অফিসার ক্যাশ’ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে এখন পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা জানে আলম মিলন ও পূবালী ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান মিলন, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার এমদাদুল হক খোকন ও সোহেল রানা (আগেই চাকরিচ্যুত), প্রশ্নফাঁসে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ চক্রের এজেন্ট ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবি জাহিদ এবং চাকরিপ্রার্থী রাইসুল ইসলাম স্বপন।

পরীক্ষা নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করে আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরিপ্রত্যাশী। আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি থেকেই প্রশ্ন ফাঁস হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে ডিবি। অন্তত ২ হাজার পরীক্ষার্থী এ প্রশ্ন পান। আর চক্রটি প্রশ্ন ও উত্তর বিক্রি করে বাগিয়ে নেয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদে গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া প্রিলিমিনারি পরীক্ষাটি বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরীক্ষার তারিখ ও সময়সূচি পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে বলে গত বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিকে আর কোনো পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার দায়ে গত ১০ নভেম্বর আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কের টেকনিশিয়ান মো. মোক্তারুজ্জামান রয়েল, ল্যাব সহকারী মো. পারভেজ মিয়া ও অফিস অ্যাটেনডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেনকে বহিষ্কার করেছে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top