মনগড়া নকশার ঘর ভেঙে আবার নির্মাণ

সুমন সিকদার, বরগুনা | প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৫৭

সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে নির্ধারিত নকশা পাল্টে বরগুনায় নির্মাণ করা হয়েছে মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। এতে সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুণœ হয়েছে ঘরের গুণগত মান। বরগুনা সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির পিআইও না থাকার সুযোগে নিজের খেয়ালখুশিমতো এসব ঘর নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছেন উপহারের এসব ঘর বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা।

এদিকে নির্ধারিত নকশা পাল্টে মনগড়া নকশায় উপহারের ঘর নির্মাণের খবর জানাজানি হওয়ার পর বরগুনার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত বুধবার থেকে ঘরগুলোর উপরের অংশ ভেঙে নির্ধারিত নকশা অনুযায়ী নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। তবে নতুন করে এই নির্মাণকাজের ব্যয় সরকারের কোন খাত থেকে আসবে তা জানা নেই বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলার পিআইও জিয়াউর রহমান। তিনি বলছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নির্দেশে কাজ শুরু করেছেন। ইউএনও মহোদয় যেভাবে বলবেন সবকিছু সেভাবেই হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের একটি মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প আশ্রয়ণ-২ এর অধীনে বরগুনাসহ সারা দেশে ৭০ হাজার ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এই উদ্যোগের অধীনে বরগুনা সদর উপজেলায় প্রথম ধাপে ৩০টিসহ পর্যায়ক্রমে মোটি ২১৯টি ঘর তৈরি করে ভূমিহীন-গৃহহীনদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব ঘরের প্রতিটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা করে। প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ উদ্যোগটিকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রণয়ন করা হয় নীতিমালা। সুবিধাভোগী বাছাই প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হয় সর্বোচ্চ সতর্কতা। দুর্নীতি ঠেকাতে ঠিকাদারদের বাদ দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা দিয়ে তৈরি করা হয় ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটি। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে ঘর নির্মাণের জন্য দেওয়া হয় আলাদা নকশা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সারা দেশে এই নকশায় গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের কথা থাকলেও বরগুনা সদর উপজেলায় ঘটেছে এর ব্যতিক্রম। নকশা বহির্ভূতভাবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির নিজের খেয়ালখুশিমতো তৈরি করেছেন এসব ঘর।

নকশা অনুযায়ী মূল ঘরের জন্য আলাদা চাল এবং বারান্দার জন্য আলাদা চাল দেওয়ার কথা থাকলেও বরগুনায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে একটি মাত্র চাল দিয়ে। এছাড়া নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালু ও কাঠসহ সব জিনিসই ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের। ফলে এসব ঘরের সুবিধাভোগীদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। নির্মাণ করা ঘরগুলোর দেয়ালের পুরুত্বও ঠিক নেই বলে অভিযোগ সুবিধাভোগীদের।

উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণের জন্য একটি বাস্তবায়ন কমিটি রয়েছে। যার সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সদস্যরা হলেনÑসহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। আর এই কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। প্রথম দফা ঘর নির্মাণের সময় এই উপজেলা পরিষদে নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন মাসুমা আক্তার। তিনি ছিলেন ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি। তখন সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার পদ শূন্য থাকায় ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেতাগী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিউল্লাহ। ওয়ালিউল্লাহ দুটি উপজেলার দায়িত্বে থাকায় বরগুনা সদর উপজেলায় পিআইওর অবতর্মানে দায়িত্ব পালন করেন ওই কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির। তিনি একজন প্রকৌশলী হওয়ায় নিজের খেয়ালখুশিমতো প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। নকশা সম্পর্কেও কাউকে অবগত করেননি।

সরেজমিনে বরগুনা সদর উপজেলার দক্ষিণ লাকুরতলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে দুই শতাধিক ঘরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কিছু ঘর নির্মাণের কাজ এখনো চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে পুনর্বাসিত করা হয়েছে ৬০টি পরিবারকে। তবে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ২১৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করার জন্য পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। ঘরগুলো দেখে প্রথমেই চমকে যেতে হবে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সারা দেশে যে নকশায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেই নকশা অনুসরণ করা হয়নি এই ঘরগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে। সম্পূর্ণ খেয়ালখুশিমতো ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।

ঘর বরাদ্দ পাওয়া আবদুর রশিদ ও মো. জহিরুলসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নকশায় ত্রুটি থাকায় বৃষ্টি হলেই ঘরের মধ্যে পানি ঢোকে। এখন পর্যন্ত সব ঘর হস্তান্তর না হলেও ইতিমধ্যেই খসে পড়ছে অনেক ঘরের পলেস্তারা। মেঝে থেকে উঠছে বালু। কেউ কেউ নিজেদের উদ্যোগে মেঝে ঠিক করলেও ঘরগুলোর গুণগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ঘর বরাদ্দ পাওয়া প্রায় সবাই।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পিআইও কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির নিজের মনগড়া নকশায় ঘর তৈরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিটি ঘরে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়। মনগড়া নকশায় ঘর নির্মাণ করে প্রতিটি ঘর থেকে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে ৩০ লাখের বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঘর নির্মাণসংক্রান্ত বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো কথাই বলা যেত না। নিজের খেয়ালখুশিমতো ঘর তৈরি করেছে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির। ধরাকে সরাজ্ঞান করে যাচ্ছে হুমায়ুন কবির। কার প্রভাবে কীভাবে হুমায়ুন কবির এত ক্ষমতা পেল সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি টাকা লুটপাটের জন্যই ঘরের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তিত নকশায় টিন কম লাগবে তাই অনেক টাকা বাঁচবে। আর এসব টাকাই আত্মসাৎ করবে ঘর নির্মাণের সঙ্গে জড়িতরা। প্রধানমন্ত্রীর এরকম একটি মহৎ উদ্যোগ কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিয়া শারমিন গত ৯ সেপ্টেম্বর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি। আমি আসার পর এখন পর্যন্ত কোনো ঘর হস্তান্তর করা হয়নি। ঘর নির্মাণে অনিয়ম কিংবা নকশাবহির্ভূত কোনো কাজ হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

তিনি আসার পরও নতুন যেসব ঘর নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোও সরকার নির্ধারিত নকশা এড়িয়ে করা হচ্ছে এমন তথ্য জানা আছে কিনা জানতে চাইলে সামিয়া শারমিন বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঘর ভেঙে নকশা অনুযায়ী নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল শুক্রবার ইউএনও সামিয়া শারমিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে গত ৯ সেপ্টেম্বর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথমে বক্তব্যের বিষয় জানতে চান। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে এই প্রতিবেদক কথা বলতে চান জানালে জেলা প্রশাসক ওই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। ‘ঘরের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না’ বলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীকালে নিজের কার্যালয়ের কনফিডেন্সিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট বা গোপনীয় সহকারীকে (সিএ) দিয়ে কল করে জেলা প্রশাসক ওইদিন বিকেল ৪টায় সাক্ষাৎকার দিতে চান। ৪টার সময় কল করা হলে সিএ বলেন, আগামী রবিবার ১০টায় সাক্ষাৎকার দেবেন জেলা প্রশাসক। তবে সেদিন আর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দেখা করা সম্ভব হয়নি। এরপর গত বৃহস্পতিবার উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে মোবাইল ফোনে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। তিনি বলেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে সঠিক ডিজাইন অনুসরণ করা হয়নি বলে শোনার সঙ্গে সঙ্গে বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে খোঁজখবর নিয়ে সঠিক ডিজাইনে ঘরগুলো নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ঘরগুলো সঠিকভাবে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।’

নতুন করে নির্ধারিত নকশায় ঘর নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলার পিআইও জিয়াউর রহমান গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইউএনও মহোদয় কাজ করতে (নকশা অনুযায়ী নির্মাণ) নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছি। তবে এ বাবদ খরচের অর্থ কোন খাত থেকে আসবে তা আমার জানা নেই। ইউএনও মহোদয় যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।’ তিন দিন ধরে কাজ চললেও এখন পর্যন্ত মিস্ত্রি ও নির্মাণশ্রমিকদের কোনো বিল দেননি বলেও জানান পিআইও।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top