গামকার মেডিকেল সেন্টারে নিঃস্ব বিদেশগামীরা

টাকায় বদলায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ

আশরাফুল ইসলাম রানা | প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৫৯

গামকার মেডিকেল সেন্টারে নিঃস্ব বিদেশগামীরা

ভোলার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। কাজের জন্য ওমানে যেতে দেশটির ভিসা পেতে ইতিমধ্যে তার ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ টাকা। গত ১৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে যান রাজধানীর ভাটারার অনুমোদিত আল মদিনা মেডিকেল সার্ভিসেস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। চার দিন পর দেওয়া রিপোর্টে আনোয়ার হোসেনের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কাছাকাছি সময়ে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে করা আরও দুটি রিপোর্টে দেখা যায় আনোয়ার হোসেনের শরীরে যক্ষ্মার কোনো জীবাণু নেই। কিন্তু আল মদিনা কর্র্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে আনোয়ার হোসেনকে আনফিট (অনুপযুক্ত) দেখিয়ে অনলাইনে তথ্য দিয়ে দেওয়ায় ওমান যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। এতে ভিসার জন্য ব্যয় করা তিন লাখ টাকা হারাতে বসেছেন দরিদ্র এই ব্যক্তি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনোয়ার হোসেন  বলেন, ‘হ্যারা আমার সব শ্যাষ কইর‌্যা ফালাইছে। আমি ডাক্তার স্যাররে ঠ্যাং পাও ধইর‌্যা অনুরোধ করছি, স্যার আমারে অন্তত ঔষধ খাওনের টাইম দ্যান। কিন্তু হ্যারা আমার কোনো কথা হোনে নাই। তুই-তুকারি কইর‌্যা বাইর কইর‌্যা দিছে। আমি শ্যাষ হইয়া গেছি।’

আনোয়ার হোসেনের মতো একই আহাজারি এখন হাজারো বিদেশগামীর। যারা গাল্ফ অ্যাপ্রুভ মেডিকেল সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন (গামকা) অনুমোদিত রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলোর হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হয়ে পথে বসছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এসব মেডিকেল সেন্টার টাকার বিনিময়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ আবার টাকা না দিলে সুস্থ ব্যক্তিকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। অনলাইনে তথ্য দেওয়ার আগে কেউ টাকা দিলে নেগেটিভ রিপোর্টকে পজিটিভ করা হয়। হয়রানি থেকে বাঁচতে অসহায় বিদেশগামীরা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দালালদের দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই অনিয়ম চললেও সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে একটি উদাহরণও নেই। এমনকি এসব মেডিকেল সেন্টারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কোনটি তা নিয়ে বিভ্রান্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকরাও।

এ প্রসঙ্গে দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী  বলেন, ‘বিদেশগামী হাজারো মানুষ প্রতিদিন এসব মেডিকেল সেন্টারের হয়রানিতে নিঃস্ব হচ্ছে। আমরা অহরহ অভিযোগ পাই। ভালো মানুষকেও এইডস রোগী বানিয়ে দেয় তারা। গুরুতর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেয়। এ জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় রেগুলেট করতে পারে না। তাদের বোঝা উচিত এখানে গরিব মানুষের স্বপ্ন জড়িত। হুট করে কাউকে আনফিট করে দিলে তার সারাজীবনের স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ভুক্ত দেশগুলোতে যেতে হলে জিসিসি অ্যাপ্রুভ্ড মেডিকেল সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশন বা গামকা অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের কেন্দ্র রয়েছে ৪৭টি। এ ছাড়া সিলেটে ১০টি ও চট্টগ্রামে ১২টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আসা বিদেশগামীদের আগে গামকার প্রধান কার্যালয় থেকে স্লিপ সংগ্রহ করতে হতো। এতে বিদেশগামীদের ভোগান্তি ছিল অসহনীয়। দুর্ভোগ এড়াতে বর্তমানে অনলাইনে স্লিপ বিতরণ করে গামকা। সেখানে যে মেডিকেল সেন্টার ঠিক করে দেওয়া হয়, সেখান থেকেই পরীক্ষা করাতে হয় বিদেশগামীদের। এর বাইরে অন্য কোনো হাসপাতাল থেকে নেওয়া সনদ সংশ্লিষ্ট দেশে যেতে গ্রহণযোগ্য হয় না।

ভুক্তভোগী, জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী ও সরেজমিনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে মেডিকেল সেন্টারগুলোতে অরাজক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হয় না। আর এই সুযোগে কেন্দ্রের পিয়ন থেকে শুরু করে চিকিৎসক ও মালিক পর্যন্ত দালালদের একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এসব সিন্ডিকেটকে টাকা দিলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করিয়েই সার্টিফিকেট দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। গতকাল শনিবার আল মদিনা মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত ৫০ ব্যক্তি ‘আনফিট’ সনদ নিয়ে বসে আছেন। যারা দালালদের হাত-পা ধরে অনুরোধ করেছেন তাদের ফিট (উপযুক্ত) সনদ করে দিতে। এই দালালরা বিদেশগামীদের সঙ্গে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস পজিটিভ এক যুবক ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে ‘ফিট’ সনদ করিয়ে নেওয়ার চুক্তি করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই যুবক  বলেন, ‘ভাই ট্যাকা পাইলে হ্যারা আকাশকে মাটিতে নামায় আনে। আর ট্যাকা না দিলে আপনি সঠিক হইলে ভুল কইর‌্যা দিবো।’

তিনি জানান, ‘আনফিট’ রিপোর্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তখনো অনলাইনে আনফিট সনদ আপলোড করে দেওয়া হয় না। যিনি যোগাযোগ করেন তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অনলাইনে ‘ফিট’ সনদ আপলোড করে দেওয়া হয়। আর যারা যোগাযোগ করে না তাদের ‘আনফিট’ দেখানো হয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, মেডিকেল সেন্টারগুলোর হয়রানির কারণে তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কারণ জিসিসিভুক্ত বেশিরভাগ দেশের ভিসা নিতে হয় সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে। সেখানে থাকা প্রতিনিধিকে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। একবার কেউ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট হলে ওই ব্যক্তি ছয় মাসের আগে আর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। এই সময়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং টাকাও আর ফেরত পাওয়া যায় না। এই ভয়ে চাহিদামতো টাকা পরিশোধ করে রিপোর্ট নিতে বাধ্য হন বিদেশগামীরা।

ফকিরাপুলের একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী  বলেন, ‘এই মেডিকেল সেন্টারগুলোর কাছে আমরা সবাই জিম্মি হয়ে গেছি। হাল্কা কাশি, সর্দি থাকলেও তারা আনফিট রিপোর্ট দেয়। এক্ষেত্রে নিয়ম আছে রোগীকে কমপক্ষে সাত দিন ওষুধ খাওয়ার সময় দিতে হবে। কিন্তু তারা প্রবাসীদের মানুষই মনে করে না। এজন্য আমরা অনেক সময় বিদেশগামীকে না পাঠিয়ে নিজেরা টাকা দিয়ে ফিট সনদ নিয়ে আসি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সার্টিফিকেট নেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে গিয়ে আবার পরীক্ষা করাতে হয়। তখন দেখা যায় অনেকে আনফিট হয়ে যায়। তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত এসব মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মানেটা কী? এর চেয়ে দেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালে এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা যাতে প্রবাসীরা করতে পারে এজন্য সরকারের উচিত জিসিসির সঙ্গে আলোচনা করা।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই বছর আগেও গামকা কর্র্তৃপক্ষ মেডিকেল সেন্টারগুলোর অনিয়ম দেখভাল করত। কিন্তু এখন এই দায়িত্ব তাদের নেই। এতে মেডিকেল সেন্টার যার যার ইচ্ছেমতো পরিচালিত হচ্ছে। ফলে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্যই পাওয়া যায়নি।

নিজ মেডিকেল সেন্টারের অভিযোগ প্রসঙ্গে আল মদিনা মেডিকেল সার্ভিসেস এর কর্ণধার ও জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বশির  বলেন, ‘মেডিকেল সার্ভিসগুলোতে যারা কাজ করে তারা সবাই পার্টটাইম কর্মী। এজন্য তারা অনেক সময় অনেক কিছু অনিয়ম করতে পারে। তবে যারা চিকিৎসক তারা এ ধরনের কাজ করবে না। কেউ যদি মনে করে রিপোর্ট ভুল হয়েছে, তাহলে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’

স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চললেও তা রোধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গামকার ওপর আমাদের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার প্রবাসীরা যে এভাবে প্রতারিত হচ্ছে বিষয়টি কেউ আমাদের সামনে আনেনি। এখন অভিযোগ পেলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নেব এবং অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। কারণ প্রবাসীর ভোগান্তি মানে আমাদের কনসার্নের বিষয়।’




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top